আজকের
অণ্বেষা
সমীর ঘটক
ঠিক বছর পাঁচেক আগে আমাদের পরিচয় হয়েছিল আরও কয়েকজন বাবা মায়ের সাথে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার সমস্যা
নিয়ে। কিন্তু তার
আগে নিজেদের জানা সীমিত পরিসরে কন্যা কৌশানীর অসুবিধা নিয়ে চেষ্টা করা কি ভাবে তার
উন্নতি সাধন করা যায়। এক দিকে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনার অভাব অন্য দিকে কঠিন লড়াই,
এই শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের সাথে মিশতে
থাকলাম আর এই সমস্যা ও তার উন্নতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে শম্ভুক গতিতে
একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার পথ প্রসারিত হতে থাকল। এই ভাবে চলতে চলতে কখন যে আমরা আরও অন্য বাবা মায়েদের
সাথে আত্ম-বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম যে একা একা থেকে যে গভীর চাপ বহন করে চলতে হচ্ছিল, তা একটু
একটু করে সরতে লাগল এবং নিজেরাও অণ্বেষার একজন হয়ে গেলাম। উপলব্ধি করতে লাগলাম এতদিনের একা চলার
পর সঠিক পথের সন্ধান পেলাম। বলে নেওয়া ভালো
যে অণ্বেষার সাথে যুক্ত হওয়ার আগে সন্তানের উন্নতির জন্যে যেখানে গেছি আন্তরিকতার অভাব
বোধ করেছি এবং দেখেছি শ্রবণ সমস্যাযুক্ত শিশুর বাবা মাদের আক্ষরিক অর্থে শোষণ করার
যে নিঃশব্দ চেষ্টা চলত, তা এখনও বিরাজমান।
যাই হোক এবার অণ্বেষা
সম্বন্ধে নিজেদের অভিজ্ঞতার দু চার কথা বলা অবশ্যই দরকার যা আমাদেরকে দৃঢ় থেকে
দৃঢ়তর করেছে। এখানের কাজ শুধু কথা বলা বা কথা শেখার মধ্যে সীমিত থাকে নি। সমাজের পাঁচটি শিশু যেভাবে নানা দিক থেকে বেড়ে ওঠে
, সেই এখানে চেষ্টা নিরলস ভাবে চলছে। তার দু একটা উদাহরণ হল যে, অণ্বেষার বাচ্চারা
স্বাভাবিক ভাবে ধীরে ধীরে স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ
থেকে বিশ্ব বিদ্যালয়ে এবং কারিগরি বিভাগ যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিজাইনিং কলেজে
সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা প্রমান করে চলেছে। এছাড়া
নাচ ও আঁকায় এখানকার কিছু কিছু বাচ্চা যথেষ্ট পারদর্শী। যতদিন যাচ্ছে বাচ্চারা তাদের
শারীরিক ভাষার যথেষ্ট উন্নতি করছে এবং আত্মবিশ্বাসও বেড়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে
অনেক বাবা মায়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে এবং তারাও বিশ্বাস ও ভরসা করতে পারছে যে শ্রবণ
প্রতিবন্ধকতার সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব।
তাই সামগ্রিক ভাবে অণ্বেষার বাচ্চাদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়
তার একটা চেষ্টা চলছে। বর্তমানে অণ্বেষা শ্রবণ
প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ছেলে মেয়েদের নিয়ে যে সমস্ত কাজ করে চলেছে তা যে কোনো অন্য
প্রতিষ্ঠানের সমান না হলেও কম নয়। কারণ অণ্বেষা
ধীরে ধীরে "বাল বিদ্যালয়ের" ধাঁচে
এখনকার বাচ্চাদের শেখানো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে
এবং আগামী দিনে বাল বিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
শিক্ষিকাদের দ্বারা আরও উন্নত শিক্ষা দেওয়ার
প্রক্রিয়া দেওয়া শুরু হবে। যে উপলক্ষে এই লেখা
যা অণ্বেষার স্মরণিকাতে প্রকাশিত হবে। তা হল
প্রতি বছরের ন্যায় এবছরেও বার্ষিক অনুষ্ঠান ২৪ শে
সেপ্টেম্বর ২০১১, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের মূল
বিষয় সামগ্রিক ভাবে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বাচ্চাদের উন্নতির লক্ষ্যে কিছু আলোচনা,
অণ্বেষার বাচ্চাদের নৃত্যানুষ্ঠান ও ছেলে মেয়েদের দ্বারা অনুষ্ঠিত একটি সামাজিক নাটক।
যা কিনা সাধারণ বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও কঠিন কিন্তু সামান্য অসুবিধা সত্ত্বেও অণ্বেষার
বাচ্চারা তা করতে সক্ষম। এটাও অণ্বেষার সাফল্যের উল্লেখযোগ্য দিক। অণ্বেষা
শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি।
সমাজের আরও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ
খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সঠিক পথ নির্দেশ করার চেষ্টা করছে। যাতে তাদের
কিছুটা উন্নতি হয়। অবশ্যই অণ্বেষার এই প্রচেষ্টা
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই করছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য
অনুষ্ঠান মানসিক অনগ্রসরতা সম্পন্ন ছেলে মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান "চিত্রাঙ্গদা"।
দীর্ঘ্ এই পথ চলতে গিয়ে নিজে একটা কঠিন উপলব্ধি করছি যে
অনেক বাবা মা তাদের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বাচ্চাদের
সঠিক ভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে নানান সমস্যায় ভুগছে, যেমন সচেতনার অভাব, সামাজিক
পরিবেশ ও আর্থিক অবস্থা। আগামী দিনে অণ্বেষা
তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে ঐ সমস্ত বাবা মায়ের
সঠিক পথ নির্দেশ যথোপযুক্ত প্রয়াস নেবে।
পরিশেষে, অভিজ্ঞতার আরও কয়েকটা কথা না বললে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তা হল,
অণ্বেষার সদস্য ও সদস্যারা তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী আন্তরিকতার সাথে ও নিঃস্বার্থ
ভাবে কাজ করে চলেছেন যা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এরই মধ্যে কারও ভূমিকা বা অংশ গ্রহণকে ছোট না করে যাদের
নাম উল্লেখ না করলে আজকের অণ্বেষা - অণ্বেষা
হয়ে উঠতে পারত কিনা তা বিতর্ক চলতে
পারে, তারা হলেন- স্নিগ্ধা সরকার, যিনি সামনের
সারিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃত দলনেত্রীর ভূমিকা পালন করে চলেছেন এবং যোগ্য সহযোগিতা দিয়ে চলেছেন
সোমা ঘোষ ও সুস্মিতা দাস। হয়তো আমার এই লেখার
মাধ্যমে কারো মনে কোনো সংশয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যা উপলব্ধি
করেছি তা নিঃসঙ্কোচে লিখতে দ্বিধা বোধ করি
নি। সব শেষে অণ্বেষার আরও উন্নতি সমাজের বিশেষ
অসুবিধা সম্পন্ন মানুষের কাছে সমস্যা সমাধানে আলোর দিশারী হয়ে পৌঁছবে এই কামনা করি।
সূত্র
: অন্বেষণ ২০১১ বার্ষিক জন সচেতনা প্রোগ্রাম
স্যুভেনির থেকে সঙ্কলিত