Saturday, August 17, 2019

কান নিয়ে অবহেলা নয় :


কান নিয়ে অবহেলা নয় 


কান নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। যে কারণে মাঝেমধ্যেই কান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় অনেককে। আর শুধু শোনা নয়, দেহের ভারসাম্য রক্ষাতেও কানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কী ভাবে কানের যত্ন নেবেন, সমস্যা হলেই বা কী করবেন, জানাচ্ছেন চিকিৎসক পার্থ রায়
৭ মার্চ , ২০১৯, ০২:০৭:৩৭, শেষ আপডেট: ৭ মার্চ , ২০১৯, ০৪:১৭:৫৮


প্রশ্ন: কানের সমস্যা নিয়ে আমরা অনেক সময়েই অবহেলা করি। এটা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে? কানের সমস্যা নিয়ে কখন সচেতন হওয়া উচিত?

কান দিয়ে আমরা শুনি অথচ গুরুত্ব দিই কম। এর ফলে বধিরতা পর্যন্ত হতে পারে। কানের যত্ন সব সময়েই নেওয়া উচিত। বিশেষ করে স্নানের সময়ে, বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ায় সময়ে, বাজি ফাটানোর সময়ে কিংবা উচ্চ স্বরের যে কোনও শব্দ থেকে দূরে থাকা উচিত। শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মহিলাদেরও বিশেষ সতর্কতা নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন: মূলত কোন বয়সের বাচ্চাদের কানের সমস্যা বেশি হয়? সাধারণত কী ধরনের সমস্যা দেখা যায়?

দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে স্কুলে যাওয়া পড়ুয়াদের (ছ’বছর পর্যন্ত) কানের সমস্যা হয় বেশি। বাচ্চাদের সাধারণত কানে ব্যথা হওয়া, কান চুলকানো, কান দিয়ে জল বেরনো বা পুঁজের মতো চটচটে আঠালো রস বার হওয়া—এমন নানা সমস্যা দেখা দেয়।

প্রশ্ন: বাচ্চাদের দেরিতে কথা বলতে শেখার সঙ্গে কানের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

বিষয় দু’টি অনেকটাই সম্পর্কিত। বাচ্চারা সাধারণত যা শোনে, তা-ই বলতে চেষ্টা করে। ছ’মাস বয়স থেকে তারা এক অক্ষর, দু’অক্ষরের শব্দ বলতে শেখে। দু’বছরের মধ্যে অনেকেই কথা বলতে শিখে যায়। বাড়িতে মা-বাবা বা অন্যেরা যা যা বলে, সেটাই বলার চেষ্টা করে।  এখন যদি কোনও বাচ্চা কথা বলতে দেরি করে, তা হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, কোনও শিশু যদি ঠিকমতো শুনতে না পায় বা শোনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়, তা হলে তার কথা বলতে দেরি হতে পারে।   

প্রশ্ন: বাচ্চার বৃদ্ধির সঙ্গে কানের সম্পর্ক আছে কি?

যদি কোনও বাচ্চা বারবার কানের অসুখে ভোগে, তখন সে খিটখিটে হয়ে যায়। বদমেজাজি হতে পারে, অল্পতেই রেগে যায়। সে কারণে সব ক্ষেত্রেই তার বিরক্তি আসে। খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো করতে চায় না। এর ফলে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কানের অসুখ আবার বিভিন্ন ভাবে হতে পারে, যেমন—কানে ময়লা জমে, কানে জল জমে বা কানের ভেতরে কোনও সংক্রমণের কারণে। তাই বলা যায়, বাচ্চার বৃদ্ধির সঙ্গে কানের সম্পর্ক রয়েছে।    

প্রশ্ন: ঋতু পরিবর্তনের কোনও প্রভাব কানে পড়ে কি? যদি পড়ে, সেগুলি কেমন?

ঋতু পরিবর্তনে কান বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে কানে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ, অর্থাৎ যখন শীতের পরে গরম আসে,  জুলাই থেকে আগস্ট অর্থাৎ বর্ষায় এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে অর্থাৎ, শীতের শুরুতে কানে সমস্যা হতে পারে। এই সময়ে সর্দি-কাশিও বেশি হয়। সর্দি কাশি বা ঠান্ডা লাগলেও কানের সমস্যা বাড়তে পারে।    

প্রশ্ন: কানের ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার না হলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে?

কানের দু’টি কাজ—শোনা এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা। তাই কানের যত্ন নেওয়া দরকার। কানের ভেতরের অংশকে রক্ষার জন্য এক ধরনের মোমের মতো বস্তু থাকে। এখন, ধুলোবালির সংস্পর্শে তা ময়লা সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করলে বধিরতাও আসতে পারে। অসাবধানবশত কানের ভেতরে জল ঢুকলে এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে পুঁজের মতো তরল সৃষ্টি করে। একে কথ্য ভাষায় ‘কানপাকা’ বলে।  এ ছাড়াও কানের সমস্যা থেকে মানসিক বিকৃতিও আসতে পারে।    
 প্রশ্ন: কান কী ভাবে পরিষ্কার করা উচিত?
প্রথমেই বলি, কানের যে কোনও সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কান পরিষ্কারের জন্য তুলো লাগানো ‘স্টিক’ ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। চিকিৎসকের পরামর্শে কানের ‘ড্রপ’ ব্যবহার করে কানের শক্ত ময়লা নরম করতে হবে। পাঁচ-সাত দিন পরপর ড্রপ ব্যবহার করলে উপশম মেলে। তা ছাড়া, খাবার খাওয়ার সময়ে, কথা বলার সময়ে বা হাঁটাচলার সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই কানের পেশির সঞ্চালনে কানের ময়লা বেরিয়ে আসে। বরং তুলো লাগানো কাঠি বা অন্য কোনও সূচালো জিনিস দিয়ে কানের ময়লা পরিষ্কারের চেষ্টা করলে তা কানের আরও ভেতরে চলে গিয়ে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 
প্রশ্ন: শীতের সময়ে কান নিয়ে কী কী সাবধানতা নেওয়া উচিত?
শীতের সময়ে সর্দি-কাশি, হাঁচি ইত্যাদি উপসর্গগুলি বেশি দেখা দেয়। এই সময়ে ঠান্ডায় নাক বন্ধ হলে অনেক সময়ে কানে তালা লেগে যায়। আর তখনই অনেকে কানে খোঁচাখুঁচি করেন। আর তা থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। তাই শীতে সর্দি-কাশি বা ঠান্ডা লাগা থেকে যতটা এড়িয়ে চলতে পারবেন, কানের সমস্যা ততই কম হবে। শীতের সময়ে প্রত্যক্ষ ভাবে কানে সমস্যা না হলেও পরোক্ষে অনেকখানি প্রভাব পড়ে।    
প্রশ্ন: স্নানের সময়ে বাচ্চাদের কানে জল ঢুকে সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত?
যদি মনে হয়, কানে জল ঢুকে বাচ্চার সমস্যা হচ্ছে তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। তুলোকাঠি দিয়ে কানে খোঁচাখুঁচি করা একেবারেই কাম্য নয়। স্নানের সময়ে বাচ্চাদের কান দু’হাত দিয়ে চেপে মাথায় জল দিলে কানে জল ঢোকার সম্ভাবনা কম থাকে।
 প্রশ্ন: কানে জল জমার সমস্যা কোন বয়সে বেশি হয়?
বাচ্চাদের কানে জল জমার সমস্যা বেশি দেখা যায়। কানে ‘ইউস্টেচিয়ান নালি’ থাকে, যার একটি প্রান্ত মধ্যকর্ণে আর অপর প্রান্ত থাকে নাকের পিছনে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই নালিটি আকারে ছোট, চওড়া ও প্রায় সোজা হয়। তাই মায়েরা দুধ খাওয়ানোর সময়ে বা বোতলে দুধ খাওয়ানোর সময়ে নাকের মাধ্যমে এই নালি দিয়ে দুধ মধ্যকর্ণে ঢুকে যায়। পরে তা সংক্রামিত হয়ে পুঁজের সৃষ্টি করে। তাই মনে রাখতে হবে, মায়ের কোলে বাচ্চাদের মাথা সমতলে না রেখে উঁচু করে রাখলে জল, দুধ কানে ঢোকার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম থাকে।
প্রশ্ন: অনেকে কানে তেল দেন। এতে কি কোনও সমস্যা হতে পারে?
কানে তেল দেওয়া একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর ফলে কানের পর্দা ও চামড়া উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
 প্রশ্ন: কানের সঙ্গে দেহের ভারসাম্য রক্ষার সম্পর্ক আছে কি?
সরাসরি সম্পর্ক আছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে কান দেহের ভারসাম্য রক্ষার কাজ করে। বিশেষত অন্তঃকর্ণ দেহের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। কানের অসুখে তাই শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
প্রশ্ন: ‘কান পাকা’ রোগ কী? এই রোগের লক্ষণগুলি কী কী?
অসাবধানবশত কানের ভেতরে জল জমলে পুঁজের মতো তরল সৃষ্টি করে। একে কথ্য ভাষায় ‘কানপাকা’ বলে। এই রোগে সাধারণত কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, শুনতে সমস্যা হয়, কানে শোঁ শোঁ বা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হয় অথবা মাথা ঘোরে। অপুষ্টি, স্বাস্থ্য-সচেতনতার অভাব এই রোগের কারণ। আগাম সতর্কতা নিলে এই রোগ আটকানো সম্ভব।
প্রশ্ন: কানে ব্যথা বা পুঁজ হলে কী করবেন?
প্রথমেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত। বিভিন্ন কারণে কানে ব্যথা হতে পারে। বাড়িতে পড়ে থাকা কানের ড্রপ ব্যবহার করা অনুচিত, ওগুলি ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা ও পদ্ধতি রয়েছে। অনেকে গরম তেল ব্যবহার করেন। সাময়িক আরাম হলেও তা বর্জন করা উচিত।
 প্রশ্ন: কানে কম শোনার কোনও প্রকারভেদ আছে কি?
কানে কম শোনার প্রকারভেদ রয়েছে। বিষয়টি দু’ভাবে হতে পারে—(১) ‘কনডাক্টিভ হিয়ারিং লস’ এবং (২) ‘সেনসরিনিউরাল হিয়ারিং লস’। কোনও শব্দ কানে প্রবেশের পরে কতকগুলি স্তর পেরিয়ে যেতে হয়। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ পেরিয়ে মস্তিষ্কে শব্দের অনুভূতি পৌঁছনোর পরে আমরা তা শুনতে পাই। এই প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি হলে শোনায় সমস্যা তৈরি হয়। কানের পর্দা বা পর্দার ভেতরের অংশে শব্দতরঙ্গ আটকে গেলে, তাকে ‘কনডাক্টিভ হিয়ারিং লস’। আর অন্তঃকর্ণ থেকে মস্তিষ্কে যাওয়ার পথে শব্দতরঙ্গ যদি আটকে যায়, তাকে ‘সেনসরিনিউরাল হিয়ারিং লস’ বলে। 
প্রশ্ন: ‘হিয়ারিং এড’ নিতে গেলে কি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ জরুরি? 
অবশ্যই। ‘হিয়ারিং এড’ প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ না খেলে ক্ষতি হতে পারে। ‘হিয়ারিং এড’ ব্যবহারের আগে কানের পরীক্ষা করানো জরুরি। এই পরীক্ষার নাম ‘অডিয়োমেট্রি টেস্ট’।
                                 
সাক্ষাৎকার: অভিজিৎ অধিকারী


No comments:

Post a Comment