এই তো জীবন
সীমন্তি রায়
এই আধুনিক যুগের নারীও কিন্তু জীবনের সার্থকতা
খুঁজে পাই সন্তানের "মা" ডাক শোনার মধ্যেই। আমার জীবনেও তার কোন ব্যতিক্রম
ঘটে নি। "১০ ই অক্টোবর ২০০৬' আমাদের
সন্তান সৌত্রিক ভূমিষ্ট হয়েছিল। আমরা মা
বাবা হলাম। শুরু হলো রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার পালা। অনেক আশা, আকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গে
অনেক আশঙ্কা আর অনেক প্রশ্নও উঁকি ঝুঁকি মারছিলো মনের মধ্যে - বাবু কি দেখতে পায় ?
বাবু কি শুনতে পায় ? বাবু কি হাঁটতে পারবে? সর্বোপরি মা বলে ডাকবে তো? উত্তর পেতে অপেক্ষা
করতে হলো। দেখলাম নিয়মমতো বাবু বসতে শিখলো।
দাঁড়াতেও শিখলো, হাঁটতেও পারল। কিন্তু শুনতে বোধ হয় পেল না। আপন মনে খেলা করত, সাড়া
দিত না। জোরে ডাকলে মাঝে মাঝে তাকাত। ভাবতাম মন দিয়ে খেলা করছে তাই বোধ হয় সব সময় সাড়া
দেয় না। ভাবিনি বাবু শুনতে পায় না। তবে সন্দেহটা ছিলই। বাবুর বাবাও লক্ষ্য করেছে। খুব
গা করেনি। আমার মতো সেও ভাবতে পারতো না এও কি হয়? আসলে আমাদের ভাবনার জগতে বধিরতা নিয়ে
কোনো ধারণা বা জানা বোঝার জায়গা ছিল না।
জগদ্ধাত্রী পূজার দিন আমাদের বাড়ির সামনে
প্রচন্ড জোরে মাইক্রোফোন বাজছে, ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নাচা-নাচি করছে, কিন্তু বাবু কেবল
প্রতিমা দেখছে। শব্দের অনুরণন কি ওর মধ্যে হয় না? প্রশ্ন ও সন্দেহ দুটোই দৃঢ় হলো। বাবুর
তখন দু বছর চার মাস বয়স। গৃহ চিকিৎসক বধিরতা নির্ণায়ক পরীক্ষা করাতে বললেন। প্রাথমিক
ভাবে খারাপ লাগায় কলকাতায় একজন প্রখ্যাত চাইল্ড
স্পেশালিস্ট এর কাছে গেলাম, তিনি BERA
করাতে বললেন। পরীক্ষা হলো, রিপোর্ট এলো Profound
Hearing Loss in Both Ears- আমার স্বপ্নের মণিময় প্রাসাদ তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়ল। চারপাশের অন্ধকার,
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চোখের জল কোনো বাধাই
সেদিন মানে নি. কারোর সান্ত্বনাই সেদিন যথেষ্ট হয় নি। আচমকাই মনে হয়েছিল জীবনটা ব্যর্থ, স্বপ্ন পূরণের
বুঝি কোনো বাস্তবটাই নেই. বাবুর বাবা কিংকর্ত্যববিমূঢ়। ডাক্তার বাবু বললেন ওকে শ্রবণ
সহায়ক যন্ত্র দিতে হবে। শুরু হলো সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়।সেই সংগ্রামের সাথী ছিলেন
আমার দুই পরিবার। তারা তাদের সাধ্যমতো আমাকে সহায়তা ও নির্ভরতা দিয়েছেন। আমার মনোবল
বেড়েছে। আমার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা লড়াই করার
ক্ষমতা এসেছে। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা এসেছে।
একটা কথা না বললেই নয়। আমরা একই দিনে কলকাতার
দুজন প্রখ্যাত E.N.T স্পেশালিস্টের পরামর্শ নিয়েছিলাম, যদি অন্য কোনো পথ থাকে। আসলে,
" বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।"
একজন মানুষের কথা না বললেই নয়, যিনি বাস্তব ও রূঢ় কথাটাই শোনালেন। খুব সহমর্মী হয়েই
শোনালেন, তিনি দক্ষিণ কলকাতার একজন প্রথিতযশা E.N.T স্পেশালিস্ট। বাবুর রিপোর্ট দেখে
বললেন- "যা হয়েছে তা ফেরানো যাবে না".
যতটুকু আছে ততটুকু দিয়ে অনেক দূর যাওয়া যাবে। আপনারা ওকে নতুন জীবন দিন. আপনাদের ও
অনেক বড় কিছু দিতে পারবে যদি আপনারা চান। কাল
সকালেই আপনাদের প্রথম কাজ হবে ওকে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র দেওয়া, ওকে শোনার আশ্চর্য জগতে
নিয়ে আসা।" - আমরা সব মুছে ফেলে দিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরোলাম। বাবু দু
বছর পাঁচ মাস বয়সে প্রথম শব্দ শুনলো।
শুনেছিলাম শল্য চিকিৎসায় কানের
পিছনে আধুনিকতম যন্ত্র বসিয়ে ঈশ্বরের
দেওয়া দানকে অস্বীকার করা
যায়। বাবা
মা কে সঙ্গে নিয়ে
আমরা চলে গেলাম ভেলোরে। সেখানকার
E.N.T Specialist বললেন - যদি ছয় মাসের মধ্যে শিশুটি
দু -একটি অর্থবহ কথা
বলে তাহলে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র
ও স্পিচ থেরাপি তে
সাফল্য পাওয়া যাবে। না হলে Cochlear Implant করাতে হবে। আমার ভেতরে জেগে
উঠলো এক অন্য "আমি".
ভেতর থেকে যেন নির্দেশ
এলো পড়তে আমাকে হবেই। বাবুকে
কথা বলাতেই হবে। আমি
চেষ্টা না করলে ও
সত্যি নির্বাক হয়ে যাবে। ওর জীবনটা থেমে যাবে,
অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আমার বাড়ি দক্ষিন
চব্বিশ পরগণার জয়নগরে। বাড়ির
সবাইকে বুঝিয়ে নতুন সংগ্রামের
ব্রত নিয়ে কলকাতায় এলাম।
স্পিচ থেরাপি চলছিলই
কিন্তু মন ভরছিল না। কোথাও যেন ফাঁকা
ফাঁকা লাগছিলো। একদিন টিভি তে একটা
অনুষ্ঠানের শেষ পাঁচ মিনিট
দেখতে পেলাম। দেখলাম বাবুর মত একটা ছোট শিশু
কেমন সুন্দর আবৃত্তি করল। অবাক হলাম। মনে একটা খুশির ছোঁয়াও
লাগলো। মনে
হলো আমি নিশ্চয়ই পারব। খুঁজবো,
খুঁজবোই সেই জায়গাটাকে যা আমার ইপ্সিত। আমি
আলো চাই,
আমি আশা চাই, আমি
আনন্দ চাই। আমি অন্ধকার চাই না। মা
হিসাবে আমি যা চাইতে
পারি তাই আমাকে চাইতে
হবে এবং পেতে হবে। হঠাৎ করে
পেয়ে গেলাম "অণ্বেষা" কে। বাঘাযতীনে অণ্বেষার
কার্যালয়। আমরা
বাবুকে নিয়ে সেখানে গেলাম। সোমাদি
আর সুস্মিতাদি
ছিলেন। ওনাদের
সাথে কথা বললাম, নিজেকে
আরো থিতু করলাম। বাবুর বাবা একটা
কথা বলা বাচ্চাকে দেখতে
চাইলেন যে এই প্রতিবন্ধকতাকে
জয় করছে। সোমাদি আর সুস্মিতাদির
কাছে যখন শুনলাম ওরাও
আমার মতই একজন বিশেষ
চাহিদা সম্পন্ন শিশুর মা, ওঁদের সন্তানরাও
আমাদের মতোই কথা বলে। একে একে স্নেহা,
দেবপ্রিয়া,নীল, ও আরো
অনেক অনেককে দেখলাম যারা
আমার বাবুর মতই।
সৌত্রিককে যে মানুষ করে
তুলতে পারব, ওকে যে
পাঁচ জনের না হোক,
দশ জনের মধ্যেও মাথা
উঁচু করে দাঁড় করতে
পারবো - এই বিশ্বাসে আমি
স্নিগ্ধাদি, সোমাদি, সুস্মিতাদি, অনিন্দিতাদি ও আরো অনেক
মায়েদের কাছ থেকে অর্জন
করেছি। আমি
অণ্বেষাতে এসে সেই হারিয়ে
যাওয়া, সেই টুকরো টুকরো
হয়ে যাওয়া ছোট্ট ছোট্ট
স্বপ্নগুলো আবার বাস্তবায়িত করে
তুলতে পাড়ার মতো মানসিক
জোর পেয়েছি। যে হাসি, যে বিশ্বাস,
যে আনন্দ আমার জীবন
থেকে মুছে গেছিলো তাকে
সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই
নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে
পেরেছি। নতুন পথে হাটতে
শুরু করেছি। কত রাস্তা যেতে হবে
জানি না। রাস্তায়
সহজ নয়। অনেক বাঁক,
অনেক চড়াই উতরাই আমায়
পার হতে হবে। তবু
যা পেয়েছি, তা অনেকটাই মনে
হয়। আজ আমি 'মা"
ডাক শুনি। টুকরো টুকরো অনেক কথা
বাবু বলে। ওর ছোট্ট
ছোট্ট চাহিদাগুলি বলে বোঝাতে পারে। এই
পারাটা আমাকে বিশ্বাস জোগাচ্ছে
এবং জোগাবে আশা করি। আমি
এই কথা মানি যে
কোনো বাধাই বাধা হয়
না যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে,
পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘন করতে
পারে। আমিও
হয়তো ইচ্ছাশক্তি ও অণ্বেষার হাত
ধরেই ধীরে ধীরে ইংলিশ
চ্যানেল পার হয়ে যাব
মাসদুর রহমান বৈদ্যের মতই।
সূত্র:
অন্বেষণ
২০১১
বার্ষিক
জন
সচেতনা
প্রোগ্রাম
স্যুভেনির
থেকে
সংগৃহীত
ভিডিও: বিশ্ব শ্রবণ দিবস উপলক্ষ্যে সৌত্রিকের শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করার উপযোগীতা নিয়ে বক্তৃতা
No comments:
Post a Comment